২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের কৃতিত্ব জীবদ্দশায় পাননি যে বাঙালি প্রত্নতাত্ত্বিক

প্রায় পাঁচ হাজার বছর পুরনো শহর মহেঞ্জোদারো -

যুক্তরাজ্যের সাময়িক পত্রিকা ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ’ ১৯২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম পাতায় প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শহর মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা আবিষ্কারের কাহিনীর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন প্রধান ও প্রখ্যাত প্রত্নত্ত্ববিদ স্যার জন মার্শাল তার লেখা এ প্রতিবেদনে প্রচুর ছবিসহ আবিষ্কারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছিলেন। তবে জন মার্শাল তার প্রতিবেদনে এটা উল্লেখ করেননি যে সিন্ধু সভ্যতার ওই দু’প্রাচীন শহরের আবিষ্কারের কৃতিত্ব আসলে ছিল ভারতীয় দুই পুরাতত্ত্ববিদের, যাদের মধ্যে ছিলেন রাখালদাস ব্যানার্জী নামের এক বাঙালি।

রাখালদাস ব্যানার্জী ছিলেন পুরাতত্ত্ব বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মী এবং প্রশিক্ষিত প্রত্নতত্ত্ববিদ, যিনি মহেঞ্জোদারো খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্যজন, দয়ারাম সাহানি যিনি আবিষ্কার করেছিলেন হরপ্পা।

এ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে পর্যন্ত কারো ধারণা ছিল না যে ভারতেও থাকতে পারে হাজার হাজার বছরের পুরনো কোনো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। প্রতিবেদনটিতে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পাকে তুলনা করা হয় গ্রিসের প্রাচীন শহর ‘টিরিনস্’ ও ‘মাইসিনের’ সাথে।

রাখালদাসের কৃতিত্ব অজানা ছিল বিশ্বের কাছে
ভারতীয়রা স্কুলের ইতিহাস বই পড়ার সুবাদে ছোট থেকেই জানে যে রাখালদাস ব্যানার্জীই খুঁজে পেয়েছিলেন মহেঞ্জোদারো। তবে বিশ্ব সেই নামটি জানতো না অনেক বছর। রাখালদাস ব্যানার্জী তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জন মার্শালকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের যে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন সেটাও প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।

সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের খবর প্রকাশিত হওয়ার এক শ’ বছর পর মহেঞ্জোদারো নিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জীর জমা দেয়া মূল সরকারি রিপোর্টটি পুনর্গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি।

প্রত্নতত্ত্ব গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলেন, ‘জন মার্শালকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জী যে মূল রিপোর্টটি পাঠিয়েছিলেন, তার একটি কপি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির এক অধ্যাপক হাতে পান। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ওই রিপোর্টের গুরুত্ব। তাই রিপোর্টটির ছবি তুলে রেখেছিলেন সেই অধ্যাপক। আমি সেই ছবিগুলো যোগাড় করি। মূল রিপোর্টের সাথে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের যেসব ছবি ছিল তার মধ্যে কিছু ছবি নানা জায়গা থেকে খুঁজে পাই। আবার যেসব ছবি পাইনি সেগুলো পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারো থেকে আমার সূত্রের মাধ্যমে ছবি তুলে আনিয়েছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই সব মিলিয়েই গোটা রিপোর্টটি পুনর্গঠন করতে পেরেছি। মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের শতবর্ষে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস ব্যানার্জীর প্রতি আমার এটা কর্তব্য ছিল।’

দীপান ভট্টাচার্য একজন প্রত্নতত্ত্ব গবেষক। তিনি সিন্ধু সভ্যতাসহ নানা প্রাচীন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।

‘মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার ছিল একটা দুর্ঘটনা’
রাখালদাস ব্যানার্জী লিখেছিলেন, ‘প্রাগৈতিহাসিক স্থল হিসেবে আমার মহেঞ্জোদারো খুঁজে পাওয়াটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। সেটা ছিল ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাস। আশপাশে বেরিয়েছিলাম চিতল হরিণ শিকার করতে। কিন্তু পথ হারিয়ে ফেলে ওই জায়গায় পৌঁছে যাই। সেখানে একটা চাঁছুনি (যা দিয়ে মাটি ইত্যাদি চেঁছে তোলা হয়) খুঁজে পাই। আসলে এটা ছিল একটা নিউমিলিটিক ফ্লিন্ট (এক ধরণের জীবাশ্ম)। একই রকম জিনিস পাশের জেলা সুক্কুরের রোহরি থেকেও কয়েক বছর আগে খুঁজে পেয়েছিলেন ব্র্যাডফোর্ড। সেগুলো এখন কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে রাখা আছে।’

ক্যালকাটা মিউনিসিপাল গেজেটের ১৯২৮ সালের ৭ নভেম্বরের যে মূল সংস্করণটি কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে, সেখানে এভাবেই নিজের প্রত্নতাত্ত্বিক কর্মজীবন তথা ভারতের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এ আবিষ্কার নিয়ে লিখেছিলেন রাখালদাস ব্যানার্জী।

প্রথমবার মহেঞ্জোদারো যাত্রার কিছুদিন আগেই ভারতের পুরাতত্ত্ব বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলের কর্মকর্তা হিসেবে পুনেতে যোগ দিয়েছেন রাখালদাস ব্যানার্জী। তার বন্ধু ও প্রখ্যাত ভাষাবিদ ড. সুনীতি কুমার চ্যাটার্জী তার ‘দ্রাভিডিয়ান অরিজিনস অ্যান্ড দ্য বিগিনিংস অফ ইন্ডিয়ান সিভিলাইজেশন’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে রাখালদাস ব্যানার্জী সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চলে গিয়েছিলেন আলেকজান্ডারের স্থাপন করে যাওয়া বিজয়স্তম্ভ ও শিলালিপির খোঁজে।

মহেঞ্জোদারো থেকে পুনেতে ফিরে এসে তিনি জানতে পারেন যে তার আগে যিনি পশ্চিমাঞ্চলের কর্মকর্তা ছিলেন, সেই ড. আর ভাণ্ডারকর নাকি ১৯১২ সালেই ওই অঞ্চল পরিদর্শন করে এসে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। রিপোর্টে তিনি বলেছেন ওই ধ্বংসাবশেষটি মাত্র দুই শ’ বছরের পুরনো।

তবে হাল ছাড়েননি রাখালদাস ব্যানার্জী। সেই ১৯১৭ সালের পরে বার বার তিনি ফিরে গিয়েছিলেন ওই অঞ্চলে। সিন্ধু নদের অববাহিকার দু’তীরেই খুঁজে বেরিয়েছেন প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ।

রাখালদাস ব্যানার্জী লিখেছেন, ‘অবশেষে আমি যখন নিশ্চিত হলাম যে মহেঞ্জোদারোই ভারতের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নক্ষেত্র, প্রাচীনতমও হতে পারে, তখন, ১৯২২ সালে আমি সেখানে খনন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই।’

বৌদ্ধ স্তূপের নিচে লুকানো প্রাচীন সভ্যতা
গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলেন, “খননের আগে মহেঞ্জোদারোতে ভূপৃষ্ঠের ওপরে যেটা দেখা যেত তা হলো কুশান যুগের একটি বৌদ্ধ স্তূপ। সেটা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের উপরেই গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেই স্তূপের নিচেই যে লুকিয়ে ছিল এক অতিপ্রাচীন অথচ আধুনিক শহর, তা জানা যায় আরো একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে। সাময়িক মাসিক বসুমতী পত্রিকায় রাখালদাস ব্যানার্জী লিখেছিলেন, ‘১৯২১ খ্রিস্টাব্দে লারকানা জিলার পশ্চিমাংশ গৈচিডেরো নামক স্থান পরিদর্শনকালে দেখিতে পাওয়া গেল যে, একটি বড়ো বাড়ি ভাঙ্গিয়া অনেকগুলি বড়ো বড়ো মাটির জালা বাহির হইয়া পড়িয়াছে। তাহার মধ্যে একটি জালার ভিতরে হাত দিতেই আমার একটি আঙ্গুল কাটিয়া গেল। সকলেই বলিল যে, উহার ভিতরে সাপ আছে এবং তোমাকে সাপে কামড়াইয়াছে। হাত বাঁধিয়া সাপ মারিবার জন্য জালা ভাঙ্গিয়া দেখা গেল যে সাপের পরিবর্তে জালার ভিতরে ১০টি মাটির ভাঁড় তিন থাকে সাজানো আছে। উপরের থাকে একটি মাটির ভাঁড়ের মুখে একখানি ছোটো পাথরের ছুরি আছে, সে ছুরিতে লাগিয়া আমার আঙ্গুল কাটিয়া গিয়াছিল। প্রত্যেক মাটির ভাঁড়ের মধ্যে মানুষের দেহের একখানি অস্থি এবং সেই অস্থির চারিপার্শ্বে তিন বা চার থাকে খুব ছোটো ছোটো ভাঁড়ে ধান, যব, গুড়, তামাক, অলংকার, কাচের বাসন, কাচের পুঁতির মালা এবং পাথরের অস্ত্র সাজানো আছে। এই আবিষ্কার করিয়া বুঝিলাম, সিন্ধুদেশের দক্ষিণভাগে যে সমস্ত ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে, উত্তরভাগের ধ্বংসাবশেষগুলো সে জাতীয় নহে।”

প্রথমে রাখালদাস ব্যানার্জী নিজে এবং তারপরে আরেক প্রত্নতত্ত্ববিদ মাধো স্বরূপ ভৎস সেখানে খননকার্য চালান। অবশেষে, ১৯২৪ সালের জুন মাসে পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ‘স্যার জন মার্শালকে আমি আবিষ্কারের বিষয়টা জানাই’ বলে উল্লেখ করেন রাখালদাস ব্যানার্জী।

প্রচুর ছবিসহ সেই তথ্য জন মার্শাল প্রকাশ করেছিলেন ‘দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজের’ প্রথম পাতায়। সেখানে রাখালদাস ব্যানার্জী বা কয়েক বছর আগে হরপ্পার আবিষ্কর্তা দয়ারাম সাহানির নাম ছিল না কোথাও।

জীবদ্দশায় মেলেনি ‘সরকারি’ স্বীকৃতি
রাখালদাস ব্যানার্জীর ভাষ্যমতে জন মার্শাল ১৯২৪ সালের মে মাসের আগে মহেঞ্জোদারোর ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। ওই পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ারও বেশ কয়েক মাস পরে, ১৯২৫ সালের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে জন মার্শাল প্রথম মহেঞ্জোদারোতে গিয়েছিলেন বলে লিখেছেন রাখালদাস ব্যানার্জী।

গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলেন, ‘এর অর্থ হলো লন্ডনের পত্রিকায় যেসব তথ্য ও ছবি ছাপা হয়েছিল জন মার্শালের নামে সেগুলো আসলে রাখালদাস ব্যানার্জী এবং তার সহকর্মীদের তোলা। অথচ কোথাও তাদের কৃতিত্ব স্বীকার করা হয়নি। জন মার্শাল নিজে একজন অত্যন্ত পণ্ডিত প্রত্নতত্ত্ববিদ। তার কাজের ব্যাপকতা বিশাল। তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশই নেই। কিন্তু অন্য কারো আবিষ্কারের স্বীকৃতি না দেয়াটাও তো ঠিক না।’

দীপান ভট্টাচার্য আরো বলেন যে লন্ডনের পত্রিকায় সেই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টে নানা অসঙ্গতি রয়েছে, বিস্তারিত তথ্য নেই এমন কথা বলেন জন মার্শাল। জন মার্শালের পর পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন হ্যারল্ড হারগ্রিভস। তিনি মূল রিপোর্টটি রাখালদাসকে ফেরত পাঠান।

দীপান ভট্টাচার্য আরো বলেন, ‘হ্যারল্ড হারগ্রিভস চিঠিতে লেখেন যে জন মার্শালই নাকি তাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন যাতে রিপোর্টটি রাখালদাসকে ফেরত পাঠানো হয়। যদি তিনি চান, সেটি প্রকাশ করতে পারেন এমন কথাও লেখা হয়েছিল।’

প্রথম প্রতিবেদনে রাখালদাস ব্যানার্জী বা দয়ারাম সাহানির নাম উল্লেখ না থাকলেও জন মার্শাল ১৯৩১ সালে ‘মহেঞ্জোদারো অ্যান্ড দ্য ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন’ নামে তিন খণ্ডের যে আকর গ্রন্থ প্রকাশ করেন সেখানে দুজনের কাজের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি।

তবে সেই বই প্রকাশের আগেই, মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মারা যান রাখালদাস ব্যানার্জী।

পুরাতত্ত্ব বিভাগ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতে এক রকম বাধ্য হন তিনি। অবসর গ্রহণের পর তিনি বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।

তার আবিষ্কারের স্বীকৃতি জীবদ্দশায় মেলেনি রাখালদাস ব্যানার্জীর।

রাখালদাসের রিপোর্ট ‘ভুলে ভরা?’
রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টটি কেন সামনে আনা হলো না অথবা লন্ডনের পত্রিকায় কেন রাখালদাস ব্যানার্জীকে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেয়া হলো না তা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ইতিহাসবিদ নয়নজ্যোত লাহিড়ী।

মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে তার লেখা বই ‘ফাইন্ডিং ফরগটেন সিটিজ- হাউ দ্য ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন ওয়াজ ডিসকভার্ডে’ নয়নজ্যোত লাহিড়ী জন মার্শালের তার উত্তরসূরি হ্যারল্ড হারগ্রিভসকে ১৯২৯ সালে লেখা একটি চিঠি থেকে হুবহু তুলে ধরেছেন।

সেই চিঠিতে পুরাতত্ত্ব বিভাগের সাবেক প্রধান জন মার্শাল লিখেছিলেন যে রাখালদাস ব্যানার্জীর রিপোর্টটি পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে সেই রিপোর্টে প্রচুর ভুল এবং অবান্তর তথ্য রয়েছে। তিনি আরো লিখেছিলেন যে এগুলো তিনি নিজের লেখা মহেঞ্জোদারোর তিন খণ্ডের বইতে সামিল করতে পারবেন না।

হ্যারল্ড হারগ্রিভসকে লেখা চিঠিতে জন মার্শাল জানিয়েছিলেন, ‘আমি রাখালদাস ব্যানার্জীকে যতটা চিনি তাতে এটা অসম্ভব নয় যে মহেঞ্জোদারোর বইতে (তিন খণ্ডের) তার সংগ্রহ করা তথ্যে তাকে স্বীকৃতি না দিয়ে ব্যবহার করলে তিনি লেখকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতেই পারেন। তাই এটাই ভালো হবে যে আপনি যদি প্রতিলিপিটি (মূল রিপোর্টের) তার কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন । তিনি যদি চান তাহলে যেন আপনি সেটি প্রকাশ করার অনুমতি দেন। তবে আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব যাতে মহেঞ্জোদারো নিয়ে তার কাজের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দেয়া হয়।’

এরপরে তিনি আরো লিখেছিলেন যে মহেঞ্জোদারো নিয়ে যে তিন খণ্ডের গ্রন্থ প্রকাশিত হতে চলেছে তা প্রকাশের আগেই যেন রাখালদাস ব্যানার্জী নিজের প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন ‘যাতে পরে কোনো ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ না থাকে।’

এটা ধরে নেয়া যেতেই পারে যে যে সময়ে জন মার্শাল রাখালদাস ব্যানার্জীর মূল রিপোর্টটি ফেরত পাঠাচ্ছেন সে সময়ে মহেঞ্জোদারো নিয়ে তার লেখা তিন খণ্ডের বিশালাকার বইয়ের রচনা ও পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে। তিন খণ্ডের ওই আকর গ্রন্থের প্রকাশকাল ছিল ১৯৩১।

গবেষক দীপান ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘লন্ডনের পত্রিকায় প্রতিবেদনটি ১৯২৪ সালে ছাপার পরেই ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ও বিদ্বজ্জনের মধ্যে রাখালদাস ব্যানার্জীর কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। জন মার্শালের ওই চিঠি এবং রাখালদাসের মূল রিপোর্টটি ফেরত পাঠানোর পিছনে এ বিষয়টি কাজ করেছে বলে মনে হয়। নানা পত্র-পত্রিকায় রাখালদাস নিজে এবং অন্য পণ্ডিতরা কিন্তু সমানে প্রবন্ধ লিখে চলেছিলেন যে কিভাবে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত হয়েছিল, কে ছিলেন আবিষ্কর্তা, ইত্যাদি। তাই জন মার্শাল তিন খণ্ডের যে আকর গ্রন্থ প্রকাশ করতে চলেছেন বছরখানেকের মধ্যেই তা যেন বিতর্কের মুখে না পড়ে সে জন্য এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন রাখালদাসের কাজকে স্বীকৃতি দিতে।’

তিনি আরো বলেন, ‘একটা বিষয় খেয়াল করার মতো- মূল রিপোর্টটি জন মার্শাল ফেরত পাঠালেন ঠিকই। কিন্তু তার সাথে রাখালদাস ও তার সহকর্মীদের তোলা যে অজস্র ছবি তার কাছে ছিল সেগুলো আর ফেরত দেয়া হয়নি। মূল রিপোর্টের যে প্রতিলিপি হ্যারল্ড হারগ্রিভস পাঠিয়েছিলেন রাখালদাসের কাছে সেখানে এই ছবিগুলো সংযুক্ত করতে না পারার জন্য দুঃখও প্রকাশ করেছিলেন।’

দীপান ভট্টাচার্য বলেন, ‘তবে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কারে নিজের মূল রিপোর্ট ফেরত আসার পর রাখালদাস আর সেটি দেখতে পেয়েছিলেন কি না আমার সন্দেহ আছে। কারণ রিপোর্টটি ফেরত আসার কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যান রাখালদাস ব্যানার্জী।’

রাখালদাসের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ
জন মার্শাল ও রাখালদাস ব্যানার্জীর মধ্যে মনোমালিন্য, মতবিরোধের শুরু অবশ্য মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার নিয়ে বিতর্কের অনেক আগে। সেই ১৯১২ সাল থেকেই।

তখন রাখালদাস ব্যানার্জী কাজ করতেন কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে। সে সময় ইংল্যান্ড থেকে ফিরে এসে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন জন মার্শাল। ভারতীয় জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগটিও জন মার্শালেরই তত্ত্বাবধানে ছিল।

ইতিহাসবিদ নয়নজ্যোত লাহিড়ী তার আকর গ্রন্থ ‘ফাইন্ডিং ফরগটেন সিটিজ- হাউ দ্য ইণ্ডাস সিভিলাইজেশন ওয়াজ ডিসকভার্ডে’এমন অনেক তথ্য দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায় জন মার্শাল ও রাখালদাস ব্যানার্জীর মধ্যে কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক মতানৈক্য ছিল।

বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য যে ‘দাম’ দিতে চাইতেন রাখালদাস ব্যানার্জী তা নিয়ে জন মার্শাল আপত্তি তুলতেন। কারণ কোনো প্রত্ন-নিদর্শনের দাম কত হওয়া উচিত, হাতে-কলমে কাজ করার সুবাদে তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা ছিল মহাপরিচালকের।

নয়নজ্যোত লাহিড়ীর বইতেই পাওয়া যায় যে প্রত্ন-নিদর্শন সংগ্রহের জন্য ‘দাম’ ঠিক করার আগে জন মার্শালের অনুমোদন নেয়ার নির্দেশ জারি করা হয়।

তবে রাখালদাস ব্যানার্জী যে একাধিকবার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সেই সব নির্দেশনা ভঙ্গ করেছেন সে কথাও উল্লেখ করেছেন নয়নজ্যোত লাহিড়ী।

এরপরে সরকারি শিলালিপি-বিশারদের (গভর্নমেন্ট এপিগ্রাফিস্ট) চাকরির জন্য যখন রাখালদাস ব্যানার্জী আবেদন করলে তাতে কিছুটা বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন জন মার্শাল। তাই সেই চাকরিটা পাননি রাখালদাস ব্যানার্জী।

পুরাতত্ত্ব বিভাগের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রধান হিসেবে রাখালদাস ব্যানার্জী যখন পুনেতে দায়িত্ব নিলেন তখন সেখানেও নানা সমস্যা শুরু হয় তাকে নিয়ে। কখনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ অমান্য করা, আবার কখনো আর্থিক অনিয়মের গুরুতর অভিযোগ উঠতে লাগল তার বিরুদ্ধে।

আবার বর্তমান মধ্যপ্রদেশের জবলপুর শহরের কাছের এক মন্দির থেকে প্রাচীন একটি মূর্তি ‘হারিয়ে যাওয়ার’ ঘটনাতেও রাখালদাস ব্যানার্জীর দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল। মূর্তিটি যখন হারিয়ে যায় সেই সময়ে রাখালদাস ব্যানার্জী তার সহকর্মীদের নিয়ে মন্দিরটির কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন। পরে অবশ্য তিনিই মূর্তিটি পুনরুদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

ভারতের জাতীয় আর্কাইভসে সংরক্ষিত একটি পুরনো ফাইল খুঁজে বের করে ইতিহাসবিদ নয়নজ্যোত লাহিড়ী লিখেছেন, ‘ফাইলটির বিষয় খুব স্পষ্ট। তা হলো রাখালদাস ব্যানার্জীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।’

ওই ফাইলে ব্যানার্জী-সংক্রান্ত চিঠি ও বিভিন্ন নির্দেশ সংকলিত রয়েছে। সংকলনের মধ্যে কিছু তার নিজের লেখা, কিছু তাকে উদ্দেশ্য করে লেখা এবং কিছু তার ব্যাপারে অন্যদের লেখা। পশ্চিম সার্কেল (পুরাতত্ত্ব বিভাগের) কী ঘটেছিল তার একটা ধারণা পাওয়া যায় ওইসব নথি থেকে।

নয়নজ্যোত লাহিড়ী লিখেছেন, ‘বোম্বে সরকারকে ১৯২১-২২ সালের শীতকালের পুরো সময়জুড়ে ব্যানার্জীর সৃষ্টি করা সমস্যাগুলো সামলাতে হয়েছিল। তারা তখন অনুধাবন করতে পেরেছিল যে তারা একজন দক্ষ অফিসারের আর্থিক নয়-ছয়ের মুখোমুখি হয়েছে। যার ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারছেন না, আবার সমাধানও করতে পারছেন না।’

মহেঞ্জোদারোতে শেষবার ফেরা
এই পরিস্থিতিতে রাখালদাস ব্যানার্জী পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান জন মার্শালকে গোপন চিঠি পাঠিয়ে বদলি চাইলেন কলকাতায়। কিছুদিন পরে ‘বোম্বে’ সরকারকে রাজি করিয়ে রাখালদাস ব্যানার্জীকে কলকাতায় বদলির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জন মার্শাল।

পশ্চিমাঞ্চল থেকে কলকাতায় ফেরত চলে আসার আগেই ১৯২২ সালে রাখালদাস ব্যানার্জী ফিরে গিয়েছিলেন মহেঞ্জোদারোতে। তখনই প্রাচীন প্রত্নস্থলটির খনন কাজ শুরু করেন তিনি।

কুষান যুগের বৌদ্ধ স্তূপের নিচ থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এক আধুনিক শহরের চেহারা।

রাখালদাস ব্যানার্জী জীবদ্দশায় সেই আবিষ্কারের স্বীকৃতি না পেলেও মহেঞ্জোদারো এখন পেয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের মর্যাদা।

পাকিস্তান সরকার সেখানে যে বোর্ড লাগিয়েছে তাতে অবশ্য জ্বলজ্বল করছে বাঙালি পুরাতাত্ত্বিক রাখালদাস ব্যানার্জীর নাম।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement